বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং নারী জাগরণের অগ্রদূত, যিনি মুসলিম নারীদের শিক্ষার প্রসারে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন স্থানীয় এক জমিদার পরিবারের কনিষ্ঠা সন্তান। তাঁর বাবা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ মানুষ। সে সময়ের সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী, মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। মেয়েদের গৃহকর্মে সীমাবদ্ধ রাখাই ছিল স্বাভাবিক। রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। তিনিই বেগম রোকেয়ার শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করেন এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখতে সহায়তা করেন।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জপূর্ণ। পরিবারের রক্ষণশীল পরিবেশে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি প্রবল বিরোধিতা ছিল। মা-বাবার বাধা থাকা সত্ত্বেও বড় ভাইয়ের সহায়তায় তিনি নিজ চেষ্টায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখতে সক্ষম হন। তিনি উপলব্ধি করেন যে শিক্ষার অভাবে নারীরা সমাজে অবহেলিত। তাঁর এই উপলব্ধি জীবনে এক অমূল্য দীক্ষা হয়ে ওঠে এবং তিনি নারীদের শিক্ষার প্রসারে কাজ করার সংকল্প নেন।
১৮৯৬ সালে বিহারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন প্রগতিশীল মুসলিম, যিনি নারীদের শিক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া তাঁর সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারের কাজ শুরু করেন। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি নারীদের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন এবং একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম ছিল তাঁর সমাজ সংস্কারের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। ১৯০৫ সালে তিনি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ রচনা করেন, যা নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার গুরুত্বকে উদ্ভাসিত করে। এই গ্রন্থে তিনি একটি কাল্পনিক বিশ্বের চিত্র অঙ্কন করেন যেখানে নারীরা ক্ষমতায় এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ‘অবরোধবাসিনী’, যেখানে তিনি সমকালীন নারীদের দুর্দশার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখায় সবসময় নারীর অধিকার, শিক্ষা এবং সমতার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
১৯১১ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া তাঁর স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যান। তিনি কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলটি মুসলিম মেয়েদের জন্য এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সমাজের প্রবল বিরোধিতা ও অর্থনৈতিক বাধা সত্ত্বেও তিনি স্কুল পরিচালনা করে গেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল মুসলিম মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলা এবং তাঁদের আত্মনির্ভরশীল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা।
বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি নারী অধিকার ও সমতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার পক্ষে কথা বলেছেন এবং নারীদের গৃহকর্মের গণ্ডি থেকে বের করে সামাজিক কাজে যুক্ত করার জন্য কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা ছাড়া নারী কখনোই সমাজে তার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার অর্জন করতে পারবে না।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, তাঁর জন্মদিনেই বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর কাজ ও আদর্শ আজও বাংলাদেশের নারী শিক্ষা ও অধিকার আন্দোলনের প্রেরণা। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, এবং সমাজ সংস্কারক।