মুহাম্মদ ইউনুস ছিলেন একজন বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
মুহাম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাজি দুলু মিয়া ছিলেন একজন সফল স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং মা সাফিয়া খাতুন ছিলেন দানশীল ও ধর্মপ্রাণ গৃহিণী। আট ভাইবোনের মধ্যে মুহাম্মদ ইউনুস ছিলেন তৃতীয়। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন চট্টগ্রামে। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান অর্জন করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ফুলব্রাইট স্কলারশিপে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শৈশব থেকেই শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁকে ভবিষ্যতে বিশ্বমানবিক কাজে অনুপ্রাণিত করে।
পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি এবং চিন্তাভাবনা ছিল ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক।
তবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ মুহাম্মদ ইউনুসের জীবনের একটি মোড় পরিবর্তনকারী অধ্যায়। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি গ্রামের দরিদ্র মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট নিজের চোখে দেখেন। এ সময় তিনি উপলব্ধি করেন, কেবল পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে সমাজের প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি তাঁকে দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করতে উৎসাহিত করে।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে তিনি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করেন। নিজ অর্থায়নে কয়েকজন দরিদ্র গ্রামীণ নারীর মধ্যে তিনি ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেন। এতে দেখা যায়, তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে সেই অর্থ কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।
এই সাফল্য তাঁকে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। এই ব্যাংকটি সরাসরি দরিদ্র মানুষ, বিশেষত নারীদের অর্থায়ন শুরু করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়। তাঁর এই ক্ষুদ্রঋণ মডেল বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয় এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের কার্যকর উপায় হিসেবে গৃহীত হয়।
মুহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবময় মুহূর্ত। নোবেল কমিটি ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার প্রদান করে।
নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনুস শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এই সম্মান তাঁকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রচারে আরও বেশি সক্রিয় করে তোলে।
মুহাম্মদ ইউনুসের উদ্ভাবনী চিন্তার আরেকটি দিক হল সামাজিক ব্যবসা। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যবসার প্রধান লক্ষ্য শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন নয়, বরং এটি সমাজের সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারে।
তিনি এই ধারণা নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করেন, যেমন:
গ্রামীণ শক্তি: যা পরিবেশবান্ধব শক্তি সরবরাহে কাজ করে।
গ্রামীণফোন: যা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বিপ্লব ঘটায়।
গ্রামীণ ড্যানোন: দুধ থেকে পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মাঝে সরবরাহ করে।
এই উদ্যোগগুলো বিশ্বের সামনে সামাজিক ব্যবসার এক নতুন মডেল উপস্থাপন করেছে।
মুহাম্মদ ইউনুসের জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি বিতর্কও এসেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম এবং পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। ২০১১ সালে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়।
এ ছাড়াও তাঁর সামাজিক ব্যবসার মডেল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। তবে সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং প্রতিজ্ঞা কখনোই কমেনি।
মুহাম্মদ ইউনুস নোবেল শান্তি পুরস্কার ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন, যেমন:
প্রেসিডেন্ট পদক
বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার
সিএনএন-টাইম "এশিয়ান হিরো
তিনি অনেক বই রচনা করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
"Banker to the Poor"
"Creating a World Without Poverty"
"A World of Three Zeros"
তাঁর বইগুলোতে তিনি ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।